‘হস্তিবাহিনী’
দ্বারা আবরাহা বাদশার সেনাবাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা কাবা শরীফে আক্রমণের
জন্য হাতির উপর সওয়ার হয়ে এসেছিল। আবরাহা ছিল ইয়েমেনের শাসক। সে ইয়েমেনে একটি
জাঁকালো গীর্জা নির্মাণ করে ইয়েমেনের অধিবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করেছিল যে, আগামীতে
কেউ হজ্জ করার জন্য মক্কায় যাবে না, এ গীর্জাকেই বাইতুল্লাহ মনে করবে। আরবের মানুষ
যদিও ছিল মূর্তিপূজক, কিন্তু হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের তালীম ও তাবলীগের বদৌলতে
কাবা শরীফের মান ও মর্যাদা তাদের অন্তরে ছিল বদ্ধমূল। তাই আবরাহার ঘোষণায় তাদের
অন্তরে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ ও দুঃখ। ফলে রাতের অন্ধকারে কেউ গিয়ে সেই গীর্জায় মলত্যাগ
করে। অন্য বর্ণনামতে গীর্জার একাংশে আগুনও লাগিয়ে দেয়। সংবাদ পেয়ে আবরাহা একটি
বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করে মক্কা মুকাররামার পথে যাত্রা করে। পথে আরবের কয়েকটি গোত্র তার
সঙ্গে যুদ্ধ করে। কিন্তু আবরাহার বিশাল বাহিনীর হাতে তারা পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত
সে বাহিনীসহ মক্কা মুকাররামার কাছাকাছি ‘মুগাম্মাস’ নামক স্থানে পৌঁছে যায়।
পরদিন ভোরে যখন সে বাইতুল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে চায়, তার হাতি অগ্রসর হতে চায়
না। ঠিক তখনই সমুদ্রের দিক থেকে অদ্ভূত ধরণের এক ঝাঁক পাখি উড়ে আসে ও পুরো
বাহিনীর উপর ছেয়ে যায়। প্রতিটি পাখির ঠোঁটে তিনটি করে কঙ্কর। তারা বাহিনীর
সেনাদের উপর কঙ্করগুলো বর্ষণ করতে শুরু করে। সে কঙ্করে এমন কাজ হয় যা
গোলা-বারুদেও হয় না। যার উপরেই কঙ্কর পড়ে, তার দেহ চিরে মাটিতে ঢুকে যায়। এই
আযাব দেখে সব হাতি পালাতে শুরু করে। কিছু সৈন্য তো সেখানেই ধ্বংস হয়, আর যারা
পালিয়ে যায়, তারা পথেই শেষ হয়। আবরাহার অবস্থা ছিল সবচেয়ে করুণ ও শোচনীয়। তার
দেহে এমন বিষ ছড়িয়ে পড়ে যে, তার একেকটি জোড়া পঁচে গলে পড়তে থাকে। এ অবস্থাতেই
তাকে ইয়েমেন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার সারা শরীর গলে গলে ঝরতে থাকে। তার
দুজন মাহুত মক্কা মুকাররামায় থেকে গিয়েছিল। তারা অন্ধ ও লুলা হয়ে যায়। এ ঘটনা
ঘটেছিল রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ জন্মের কিছুকাল
পূর্বে।... এ সূরায় ঘটনাটি উল্লেখ করে মূলতঃ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি অসীম। যারা আপনার
বিরুদ্ধে কোমর বেঁধেছে, তারাও শেষ পর্যন্ত হস্তিবাহিনীর মত ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ সূরার
পটভূমি এই যে, জাহিলী যুগে অর্থাৎ হুযূর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ আবির্ভাবের
পূর্বে আরব অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা, হত্যা-লুণ্ঠন ও যুলুম-অবিচার মারাত্মক আকার ধারণ
করেছিল। কোন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে নিরাপদে সফর করতে পারত না। কেননা, পথে চোর-ডাকাত
ও শত্র“র পক্ষ হতে আক্রমণের আশংকা ছিল। কিন্তু কুরাইশ গোত্র যেহেতু বাইতুল্লাহর আশপাশেই
বসবাস করত এবং এ গোত্রের লোকেরাই বাইতুল্লাহর সেবা করত, তাই সমগ্র আরববাসী তাদেরকে
সম্মান করত। তাই তারা শীতকালে ইয়েমেনে ও গ্রীষ্মে শামে বাণিজ্যিক সফর করতে অভ্যস্ত
ছিল। এসব সফরের উপরই নির্ভরশীল ছিল তাদের আয়-রোজগার। মক্কা মুকাররামায় কোনো ক্ষেত-খামার
ও বাগান ছিল না, তবুও এসব সফরের কারণে তাদের জীবন ছিল সচ্ছল ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ।
এখানে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, সমগ্র আরবে তাদের ইজ্জত,
স্বাধীনভাবে নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে বাণিজ্যিক সফরের সুযোগ এসবই বাইতুল্লাহর বরকতে।
এর প্রতিবেশী হওয়ার কারণেই তাদের এ সম্মান ও মর্যাদা। অতএব এই গৃহের মালিকের ইবাদতে
নিমগ্ন হওয়া ও মূর্তিপূজা ছেড়ে দেওয়া তাদের একান্ত কর্তব্য।
কতিপয় কাফির
সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তাদের কাছে কোনো ইয়াতীম সাহায্য চাইতে আসলে ধাক্কা দিয়ে
বের করে দেয়। এমন কাজ যে কারো জন্যই নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক ও বড় গুনাহ। কিন্তু কাফেরদের
কথা উল্লেখ করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ কাজ আসলে কাফিরদেরই, কোনো মুসলমান
থেকে তা কিছুতেই আশা করা যায় না।
অর্থাৎ
নিজে তো কোনো গরীবকে সাহায্য করেই না, অন্যকেও করতে উৎসাহিত করে না।
মোটেই না
পড়া তো নামাযের প্রতি চরম অবহেলা, ছহীহ তরীকায় না পড়াও গাফলতির অন্তর্ভুক্ত।
. অর্থাৎ
তারা নামায পড়লেও আল্লাহর রিযামন্দির পরিবর্তে মানুষকে দেখানোর জন্যই পড়ে। এটি
মূলতঃ মুনাফিকদেরই কাজ।
. ‘কাউছার’
এর শাব্দিক অর্থ : প্রভূত কল্যাণ। জান্নাতের বিশেষ একটি হাউজের নামও কাউছার, যা
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্তৃত্বাধীন থাকবে এবং তাঁর উম্মতের
লোকেরা সে পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত হবে। হাদীছ শরীফে এসেছে, সে হাউজের পেয়ালা হবে
আকাশের তারকারাজির মত বিপুলসংখ্যক। এখানে উভয় অর্থই প্রযোজ্য।
. ‘আবতার’
শব্দের অর্থ ‘শেকড়-কাটা’। আরবের লোকেরা পুত্র সন্তানহীন ব্যক্তির জন্য এ শব্দটি
ব্যবহার করত। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র সন্তানদের ইন্তিকালের
পর আছ ইবনে ওয়াইল ও অন্যান্য কাফিররা কটাক্ষ করে বলতে শুরু করে, তিনি আবতার, তার
বংশধারা চলবে না। এরই উত্তরে আল্লাহ তাআলা সূরাটি নাযিল করেছেন। এতে বলা হয়েছে,
আল্লাহ তাআলা তো আপনাকে কাউছার দান করেছেন। সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আপনার
স্মরণকারী এবং আপনার দীনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিবেদিতপ্রাণ রূহানী সন্তান
হবে অসংখ্য ও অগণিত। আপনার শত্র“রাই ‘আবতার’, মৃত্যুর পর তাদের কোনো নাম-নিশানা
থাকবে না। বাস্তবে তাই হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
পবিত্র জীবন-চরিতের চর্চা সর্বাধিক সজীব ও জীবন্ত। অথচ তাঁর নিন্দাকারীদেরকে কেউ
চিনেও না, আর কেউ তাদের নামোল্লেখ করলেও ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের সাথেই করে।
এ সূরাটি
নাযিল হওয়ার পটভূমি এই, ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা, আছ ইবনে ওয়াইল প্রমুখ মক্কার কিছু
নেতা রাসূলুল্লাহ ছাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই প্রস্তাব পেশ করে যে, এক বছর
আপনি আমাদের উপাস্যদের পূজা করুন, পরের বছর আমরা আপনার মাবুদের ইবাদত করব। তাদের
জবাবে কুরআন মজীদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছে যে, কুফর ও ঈমানের মধ্যে এমন সমঝোতার
আদৌ সুযোগ নেই, যার ফলে হক ও বাতিলের প্রভেদ মোছে যাবে। সত্য দীনে কুফর ও শিরকের
মিশ্রণ হতে পারে না। যদি তোমরা সত্যকে গ্রহণ না কর, তবে তোমাদের ভ্রান্ত ধর্মে থাক।
কিন্তু একদিন অবশ্যই তার ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। এর দ্বারা বুঝা যায়, অমুসলিমদের
সাথে এমন কোন চুক্তি জায়েয নেই, যার ফলে তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতি গ্রহণ করতে হয়।
হ্যাঁ, আপন দীনের উপর অবিচল থেকে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি হতে পারে।
. অধিকাংশ মুফাসসিরীনের
মতে এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে মক্কা-বিজয়ের কিছুকাল পূর্বে। এতে একদিকে
সুসংবাদ
দেওয়া হয়েছে যে, অচিরেই মক্কা মুকাররামা বিজিত হবে এবং আরবের লোকেরা দলে দলে ইসলামে
দীক্ষিত হবে, আর বাস্তবে তাই হয়েছিল; অপরদিকে এ ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ইসলামের
বিস্তারের কারণে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য
পূর্ণ হওয়ার সময় হয়েছে। তাই তাঁকে দুনিয়া থেকে বিদায়ের প্রস্তুতির জন্য আল্লাহর হামদ,
তাসবীহ ও ইস্তিগফারের আদেশ করা হয়েছে। এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর সুসংবাদের কারণে
অনেক ছাহাবায়ে কেরাম আনন্দিত হন; কিন্তু রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাজান
হযরত আব্বাস রা. কাঁদতে আরম্ভ করেন। তিনি বলেন, এ সূরা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে,
হুযূর ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুনিয়া থেকে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।
যদিও রাসূলুল্লাহ
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব ধরণের গুনাহ থেকে পরিপূর্ণ মুক্ত ও নিষ্পাপ
এবং তার শান হিসেবে (গুনাহ নয় এমন) কোনো ভুল-ক্রটি যদি হয়ে যায়, তাও আল্লাহ তাআলা
ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন সূরা ফাত্হ এর ৪৮ নং আয়াতে। তা সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা
প্রার্থনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে একথা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, যখন রাসূলুল্লাহ
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইস্তিগফার করতে বলা হচ্ছে, তখন অন্যান্য মুসলমানদের
তো সমধিক গুরুত্ব সহকারে আরো বেশি ইস্তিগফার করা উচিত।
আবু লাহাব
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক চাচা। ইসলামের দাওয়াতের পর সে
তাঁর শত্র“ হয়ে যায় এবং বিভিন্নভাবে তাঁকে যন্ত্রণা দিতে থাকে। প্রথম বার যখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ছাফা’ পর্বতে আরোহণ করে স্বীয় গোত্রের লোকদেরকে ইসলামের প্রতি
আহ্বান করেন, তখন সে বলেছিল, “ধ্বংস হও তুমি, এজন্যই কি আমাদেরকে ডেকেছ?”। তার
উত্তরে এ সূরা নাযিল হয়। এর প্রথম আয়াতে আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়ে বলা হয়েছে, মহানবী
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয়, বরং আবু লাহাবের দু’হাতই ধ্বংস হোক। আরবী
পরিভাষায় ‘হাত ধ্বংস হওয়া’ দ্বারা ব্যক্তির ধ্বংসকেই বুঝানো হয়। তারপর বলা হয়েছে,
‘সে তো ধ্বংস হয়েই গেছে।’ অর্থাৎ তার ধ্বংস এমনই নিশ্চিত যে, তা যেন হয়েই গেছে। ফলে
বদর যুদ্ধের সাত দিন পর তার দেহে ‘আদাসা’ নামক একটি মহামারী রোগ দেখা দেয়। আরবের
লোক ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাসী ছিল। আদাসা রোগীকে তারা স্পর্শ করত না। কাজেই সে
ঐ রোগেই অস্পৃশ্য অবস্থায় মারা যায়। তার লাশে মারাত্মক দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। তাই লোকেরা তাকে
লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে একটি গর্তে মাটিচাপা দেয়। [রুহুল মাআনী]
. আবু লাহাবের
স্ত্রীর নাম উম্মে জামীল। সেও রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্র“তায়
স্বামীর পূর্ণ সহযোগী ছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, সে মহানবী ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত এবং বিভিন্নভাবে তাঁকে কষ্ট দিত।
. ‘কাষ্ঠ
বহনরত অবস্থায়’-এর দু ধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এক. উম্মে জামীল যদিও অভিজাত
পরিবারের নারী ছিল, কিন্তু ছিল ভীষণ কৃপণ। তাই সে নিজেই মুঞ্জ (এক প্রকার তৃণ)
এর রশি দিয়ে বেঁধে জ্বালানি কাঠ বহন করে আনত। কেউ কেউ বলেন, সে নবীজি ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলাচলের পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা
হয়েছে। উভয় অবস্থাতেই কাষ্ঠ বহনের বিষয়টি দুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। দুই. কতিপয় মুফাসসিরীনের
মতে এখানে জাহান্নামে প্রবেশের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সে মুঞ্জের রশিতে
কাষ্ঠ বহনরত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
কোনো কোনো
কাফির রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি যে
মাবুদের ইবাদত করেন, তিনি কেমন? তাঁর বংশপরিচয় বলুন। এর জবাবে সূরাটি অবতীর্ণ
হয়েছে।
. ‘সর্বদিক
থেকে এক’ এর দ্বারা ‘আহাদ’ শব্দের তরজমার চেষ্টা করা হয়েছে। কেবল ‘এক’ বললে আহাদ
এর সম্পূর্ণ মর্ম আদায় হয় না। ‘সর্বদিক থেকে এক’ এর ব্যাখ্যা এই যে, তাঁর সত্তা
এক। তাঁর কোনো অংশ
নেই, খণ্ড
নেই। তাঁর গুণাবলী অন্য কারো মধ্যে পাওয়া যায় না। মোটকথা তিনি সত্তার দিক থেকেও
এক এবং গুণাবলীর দিকে থেকেও এক।
. ‘সকলে
তাঁর মুখাপেক্ষী, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন’ এটি ‘আছ-ছামাদ’-এর তরজমা। এ শব্দের
মর্মও কোনো এক শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সাধারণতঃ এ শব্দের তরজমা করা
হয় ‘অমুখাপেক্ষী’। কিন্তু তা পরিপূর্ণ তরজমা নয়।
সূরাটিতে
আল্লাহ তাআলা অতি সংক্ষেপে তাওহীদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তুলে ধরেছেন। প্রথম আয়াতে
বহু ঈশ্বরবাদীদেরকে খণ্ডন করা হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে তাদের মতবাদকে খণ্ডন করা হয়েছে,
যারা আল্লাহকে এক জানা সত্ত্বেও অন্য কাউকে বিপদ থেকে উদ্ধারকারী, প্রয়োজন সমাধাকারী বা
কর্মবিধায়ক ইত্যাদি বিশ্বাস করে। তৃতীয় আয়াতে তাদের বিশ্বাসকে খণ্ডন করা হয়েছে, যারা আল্লাহর
জন্য সন্তান সাব্যস্ত করে। চতুর্থ আয়াতে সেসব লোকদের ধ্যান-ধারণা বাতিল করা হয়েছে,
যারা আল্লাহর কোনো গুণে অন্য কাউকে তাঁর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। যেমন অগ্নিপূজক সম্প্রদায়
বলত, আলোর স্রষ্টা একজন, অন্ধকারের স্রষ্টা আরেকজন; অনুরূপ মঙ্গল সৃষ্টিকারী একজন, অমঙ্গল
সৃষ্টিকারী আরেক জন। এভাবে এই সংক্ষিপ্ত সূরায় সর্বপ্রকার শিরকী মতবাদ খণ্ডন করে নির্ভেজাল
তাওহীদ উপস্থাপন করা হয়েছে। এজন্যই এ সূরার নাম সূরা ইখলাছ। একটি ছহীহ হাদীছে
আছে, সূরা ইখলাছ কুরআন করীমের এক-তৃতীয়াংশ। বাহ্যত তার কারণ এই যে, কুরআন করীমে
মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে : তাওহীদ, রিসালত, আখিরাত।
সূরা ইখলাছ তন্মধ্যে তাওহীদের বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছে। বিভিন্ন হাদীছে সূরা ইখলাছ
তিলাওয়াতের অনেক ফজীলত বর্ণিত হয়েছে।
কুরআন করীমের
শেষ দুই সূরা নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট এই যে, ইহুদীরা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামের উপর জাদু করার চেষ্টা করেছিল। তাদের জাদুর কিছু ক্রিয়া তার উপর প্রকাশও
পেয়েছিল। তাই জাদু-টোনা থেকে হিফাজতের জন্য তাঁকে এ দুই সূরার শব্দাবলী দ্বারা
আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি হাদীছ দ্বারা জানা যায়, জাদুর
ক্রিয়া নষ্ট করার জন্য এ দুই সূরা তিলাওয়াত করে দম করা অত্যন্ত কার্যকর। রাসূলুল্লাহ
ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোয়ার পূর্বে এ সূরাগুলো তিলাওয়াত করে হাতে দম
করতেন, এরপর হাত সমগ্র শরীরে বুলিয়ে নিতেন।
. অন্ধকার
রাতের অনিষ্ট থেকে বিশেষভাবে এজন্য আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে যে, জাদুকররা সাধারণতঃ
রাতের অন্ধকারেই তাদের অপকর্ম বাস্তবায়ন করে।
.
‘ব্যক্তি’ শব্দ দ্বারা নারী ও পুরুষ উভয়কেই বুঝানো হয়েছে। জাদুকর নারী ও পুরুষরা সুতায়
গিরা দিয়ে তাতে ফুঁক দিয়ে থাকে। এ আয়াতে তাদের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।
পূর্ববর্তী
সূরার ১নং টীকা দেখুন।
অর্থাৎ
আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই, যিনি সকলের প্রতিপালক, প্রকৃত অর্থে সকলের বাদশাহ এবং
সকলের মাবুদ।
একটি নির্ভরযোগ্য
হাদীছে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে শিশুই
জন্মগ্রহণ করে, কুমন্ত্রণা দেওয়ার জন্য তার অন্তরে শয়তান চেপে বসে। বড় হওয়ার পর যখন
সে আল্লাহর যিকিরে মগ্ন হয় কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান পেছনে অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার যখন যিকির
থেকে উদাসীন হয়, পুনরায় এসে কুমন্ত্রণা দেয়। [রুহুল মাআনী, ইমাম হাকিম, ইবনুল মুনযির
ও যিয়া এর বরাতে]
. সূরা
আনআমে (৬ : ১১২) বলা হয়েছে, শয়তান যেমন জিনদের মধ্যে হয়, তেমনি মানুষের মধ্যেও
হয়। তবে জিন শয়তানদেরকে চোখে দেখা যায় না, বরং অদৃশ্যভাবে অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়।
আর মানুষ শয়তানদেরকে চোখে দেখা যায়। তারা এমন সব কথাবার্তা বলে, যা শুনে অন্তরে
নানা কুচিন্তা ও প্ররোচণা সৃষ্টি হয়। তাই এ সূরায় উভয় ধরণের কুমন্ত্রণাদাতা থেকে
আশ্রয় চাওয়া হয়েছে।
এ আয়াতসমূহে
যদিও শয়তানের কুমন্ত্রণা দেওয়ার ক্ষমতার কথা জানানো হয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে আল্লাহর
কাছে আশ্রয় চাওয়ার আদেশ প্রদান করে এও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাঁর কাছে আশ্রয়
প্রার্থনা করলে এবং তাঁর যিকির করলে শয়তান দূরে সরে যায়। সূরা নিসায় (৪ : ৭৬)
বলা হয়েছে, শয়তানের কৌশল দুর্বল। মানুষকে গুনাহে বাধ্য করার শক্তি তার নেই। সূরা
ইবরাহীমে (১৪ : ২২) স্বয়ং শয়তানের স্বীকারোক্তি বর্ণনা করা হয়েছে যে, ‘মানুষের
উপর আমার কোনো আধিপত্য নেই’। বস্তুতঃ শয়তান যে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে,
তা মানুষের প্রতি একটি পরীক্ষা। যে ব্যক্তি তার ধোঁকায় পড়তে অস্বীকার করে আল্লাহর
কাছে পানাহ চায়, শয়তান তাকে কিছুই করতে পারে না।